Tuesday, 18 August 2015

যৌক্তিক সংজ্ঞা, চক্রক সংজ্ঞা, সংজ্ঞার সীমা, সংজ্ঞা ও বর্ণনা

পাঠের শিরোনাম: যৌক্তিক সংজ্ঞা কাকে বলে?
ভূমিকাঃ যুক্তিবিদ্যায় যুক্তিকে যথার্থরূপে প্রয়োগ করার প্রয়োজনে যুক্তিবাক্যের অন্তরগত পদদ্বয়ের অর্থ সুনিদিষ্ট ও সুস্পষ্ট হওয়া আবশ্যক। আর পদের সুনির্দিষ্ট ব্যবহারের জন্যই যৌক্তিক সংজ্ঞা সম্পর্কিত আলোচনা গুরুত্বপূণ। কেননা, যৌক্তিক সংজ্ঞার অর্থ হল পদের সংজ্ঞা।

যৌক্তিক সংজ্ঞা কাকে বলে?
যৌক্তিক সংজ্ঞার অর্থ হল, একটা পদের পূর্ণ জাত্যর্থকে সূস্পষ্টভাবে প্রকাশ করা। সংজ্ঞাদানের উদ্দেশ্য হলো কোন পদের অর্থকে পরিস্কারভাবে ব্যক্ত করা। যুক্তিবিদ্যায় একমাত্র জাত্যর্থ প্রকাশের মাধ্যমেই পদের অর্থকে ব্যক্ত করা হয়। আমরা জানি যে, একটি পদের জাত্যর্থ তার সাধারণ ও আবশ্যকীয় গুণ বা গুণসমূহ দ্বারা গঠিত হয়। সুতরাং একটি বাক্যের মাধ্যমে ঐরূপ গুণ বা গুণসমূহের সুস্পষ্ট উল্লেখকে যৌক্তিক সংজ্ঞা বলে। তাই যুক্তিবিদ ওয়েলটন বলেন যে, “একটা পদের সম্পূর্ণ জাত্যর্থকে সূস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করাই হল যৌক্তিক সংজ্ঞা।”
উদাহরণ ও বিশ্লেষণঃ  ‘মানুষ’ পদের সংজ্ঞায় বলা হয়, ‘সব মানুষ হল বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন জীব।’ কেননা, মানুষ পদের জাত্যর্থ হল বুদ্ধিবৃত্তি ও জীববৃত্তি। মানুষের মধ্যে আরও কতকগুলো সাধারণ গুণ যেমন- হাসি, কান্না, ক্ষুধা, তৃষ্ণা ইত্যাদি বর্তমান আছে। তবে এগুলি মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ এগুলো হয় বুদ্ধিবৃত্তি, না হয় জীববৃত্তির মধ্যে নিহিত। উপসংহারঃ যৌক্তিক সংজ্ঞার লক্ষ্য হচ্ছে একটি পদের জাত্যর্থকে সূস্পষ্ট করা। আর সূস্পতার ফলে একটি পদের অর্থ ও তাৎপর্য আমাদের কাছে সহজবোধ্য হয়।
 পাঠের শিরোনাম: চক্রক সংজ্ঞা অনুপপত্তি ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকাঃ কোন পদের জাত্যর্থের সুস্পষ্ট বিবৃতিকে যৌক্তিক সংজ্ঞা বলে। সংজ্ঞাকে সঠিক হতে হলে কতকগুলো নিয়মের অধীনস্ত হতে হয়। আর এ নিয়ম লঙ্ঘন করলে কতকগুলো অনুপপত্তি ঘটে। চক্রক সংজ্ঞা অনুপপত্তি তাদের মধ্যে অন্যতম।
চক্রক সংজ্ঞা অনুপপত্তিঃ চক্রক সংজ্ঞা একটি ত্র“টিপূর্ণ সংজ্ঞা। সংজ্ঞার তৃতীয় নিয়মটি লঙ্ঘন করলে এরূপ অনুপপত্তি ঘটে। তৃতীয় নিয়মটি হলো- যে পদের সংজ্ঞা দিতে হবে সেই পদ বা তার প্রতিশব্দ সংজ্ঞায় ব্যবহার করা যাবে না। সংজ্ঞায় এ নিয়মটি অমান্য করে আমরা যদি কোন পদের সংজ্ঞা নির্ণয় করতে গিয়ে একই কথার পুনরুক্তি করি তাহলে সংজ্ঞাটি ত্র“টিপূর্ণ হবে এবং এরূপ সংজ্ঞা চক্রক সংজ্ঞা নামে পরিচিত। চক্রক সংজ্ঞায় আসলে পদ সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না। বরং একই কথা বুঝিয়ে বলা হয়।
উদাহরণ ও বিশ্লেষণঃ ‘সব মানুষ হলো মানব সন্তান’।
আলোচ্য ক্ষেত্রে ‘মানুষ’  পদের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে ‘মানব সন্তান’ হিসাবে। কিন্তু ‘মানব সন্তান’ পদ ‘মানুষ’ পদের সমার্থক। এখানে মানুষের কোন গুণকে উল্লেখ করা হয়নি বরং মানুষকে ‘মানব সন্তান’ বলে চালানো হয়েছে। এখন আবার ‘মানুষ’ পদের অর্থ সুনির্দিষ্ট করতে হলে ‘মানব সন্তান’ পদের সংজ্ঞা দেওয়া আবশ্যক। সে হিসাবে আলোচ্য সংজ্ঞার ক্ষেত্রে চক্রক সংজ্ঞা নামক অনুপপত্তি ঘটেছে।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায়, কোন পদের সংজ্ঞায় সেই পদ বা তার প্রতিশব্দ ব্যবহার করলে চক্রক সংজ্ঞা নামক অনুপপত্তি ঘটবে। 


পাঠের শিরোনাম:  যৌক্তিক সংজ্ঞার সীমা আলোচনা কর।


ভূমিকাঃ কোন পদের সম্পূর্ণ জাত্যর্থ উল্লেখ করাকেই যৌক্তিক সংজ্ঞা বলে। কিন্তু যে সব ক্ষেত্রে সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয় তাই হলো সংজ্ঞার সীমা।

যৌক্তিক সংজ্ঞার সীমাঃ কোন পদের সংজ্ঞা দানের সময় পদের আসন্নতম জাতি ও তার বিভেদক লক্ষণ উল্লেখ করতে হয়। কিন্তু কতকগুলো ক্ষেত্র আছে যেখানে এভাবে সংজ্ঞা দান সম্ভব নয়। নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলোঃ
    ১. পরমতম জাতিঃ পরমতম জাতি বা বৃহত্তম জাতির আসন্নতম জাতি নেই বলে তাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। যেমন- ‘দ্রব্য’। ‘দ্রব্যের’ আসন্নতম জাতি নেই বলে তার সংজ্ঞা দেওয়া যায় না।
    ২. স্বকীয় নামবাচক পদঃ স্বকীয় নামবাচক পদগুলো অজাত্যর্থক বলে তাদের সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। যেমন- ঢাকা, করিম ইত্যাদি। এসব নাম নির্দেশিত ব্যাক্তি বা বস্তুর বিভেদক লক্ষণ নির্ণয় করা সম্ভব নয় বলে এদের সংজ্ঞা দেওয়া যায় না।
    ৩. বিশিষ্ট গুণবাচক পদঃ বিশিষ্ট গুণবাচক পদের সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। যেমন- সততা, সত্যবাদিতা, মিষ্টত্ব ইত্যাদি। এই পদগুলো এতই সরল যে, এদের অর্থকে আর পরিস্কার করা যায় না। কাজেই এদের সংজ্ঞা দান সম্ভব নয়।
    ৪.  অনন্য পদঃ  অনন্য পদের জাত্যর্থ নেই বলে এর সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। যেমন- দেশ, কাল  ইত্যাদি। এসব বিষয় বিশ্লেষণ করা যায় না বলে এদের সংজ্ঞা দেওয়া যায় না।
    ৫. বিশিষ্ট বস্তুঃ বিশিষ্ট বস্তুর অসংখ্য বৈশিষ্ট থাকলেও, এর সব বৈশিষ্ট নির্ণয় করা যায় না। এ কারণে বিশিষ্ট বস্তুর সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। যেমন- পদ্মা, তাজমহল ইত্যাদি।
    ৬. মৌলিক অনুভূতিঃ ব্যাক্তি বিশেষের মৌলিক অনুভূতির সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। যেমন- সুখ, দুঃখ, আনন্দ,বেদনা, প্রেম, বিরহ ইত্যাদি। এই গুণগুলো অন্য কিছুর সাথে তুলনা করা যায় না বিধায় এদের সংজ্ঞা সম্ভব নয়।                    
    ৭. পরম নিয়মঃ পরম নিয়ম হলো ব্যাপকতর নিয়ম। এদের তুলনায় কোন ব্যাপকতর নিয়ম নেই বলে, এর আসন্নতম জাতি নেই। তাই পরম নিয়মের কোন সংজ্ঞা দেওয়া যায় না।
উপসংহারঃ উল্লেখিত ক্ষেত্রসমূহে বর্ণিত সমস্যার কারণে যৌক্তিক সংজ্ঞা নির্দেশ করা সম্ভব হয় না। এগুলো হলো যৌক্তিক সংজ্ঞার সীমা। 


পাঠের শিরোনাম: যৌক্তিক সংজ্ঞা ও বর্ণনার মধ্যে পার্থক্য দেখাও। 

ভূমিকাঃ যৌক্তিক সংজ্ঞা ও বর্ণনার মধ্যে পার্থক্য নিরূপনের পূর্বে আমাদের জানা প্রয়োজন সংজ্ঞা ও বর্ণনা কি বা কাকে বলে? কোন পদের জাত্যর্থের সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করাকে যৌক্তিক সংজ্ঞা বলে, আর কোন পদের উপলক্ষণ অথবা অবান্তর লক্ষণ অথবা জাত্যর্থের অংশ বিশেষের সাথে এগুলো মিশিয়ে উল্লেখ করাকে বর্ণণা বলে।
উদাহরণ স্বরূপঃ মানুষের সংজ্ঞা – “মানুষ হয় এক প্রকার বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন জীব।”
                       মানুষের বর্ণনা – “ মানুষ হয় এক প্রকার পক্ষবিহীন দ্বিপদ জীব।”
যৌক্তিক সংজ্ঞা ও বর্ণনার মধ্যে পার্থক্যঃ সংজ্ঞা ও বর্ণনার মধ্যে নিম্নের পার্থক্যগুলো লক্ষণীয়। যেমন-
১. সংজ্ঞায় একটা পদের আসন্নতম জাতি ও বিভেদক লক্ষণ উল্লেখ করতে হয়। কিন্তু বর্ণনার ক্ষেত্রে উপলক্ষণ বা অবান্তর লক্ষন বা উভয়কেই উল্লেখ করা হয়।
২. সংজ্ঞা হল বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া কারণ সংজ্ঞার মাধ্যমে কোন পদ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা সম্ভব। আর বর্ণনার মাধ্যমে কোন বিষয় সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা লাভ করা যায়। সে হিসাবে বর্ণনাকে বলা যায় লৌকিক প্রক্রিয়া।
৩. সব পদের সংজ্ঞা দেওয়া যায় না কিন্তু বর্ণনা দেওয়া যায়। যেমন, বিশিষ্ট নামের বিভেদক লক্ষণ নির্ণয় করা যায় না বিধায় সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। কিন্তু যে কোন বিশিষ্ট নামের বর্ণনা দেওয়া যায়।
৪. সংজ্ঞা দেওয়া হয় কোন পদের। কিন্তু বর্ণনা দেওয়া হয় কোন বিষয় বা বস্তুর। সংজ্ঞা পদের সাথে সম্পর্কীত।
৫. একটা পদের অর্থ সুনিদিষ্ট বলে, কোন পদের একটা সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু, একটা বস্তুকে নানাভাবে বর্ণনা দেওয়া যায় বলে, কোন বস্তুর একাধীক বর্ণনা হতে পারে।
৬. সংজ্ঞায় আসন্নতম জাতি ও বিভেদক লক্ষণ উল্লেখ করতে হয় বলে সংজ্ঞা তুলনামূলকভাবে জটিল প্রক্রিয়া। কিন্তু, বর্ণনায় তা করতে হয় না বলে তুলনামূলকভাবে সহজ সরল প্রক্রিয়া।
৭. সংজ্ঞায় সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। কিন্তু বর্ণনায় সুনিদিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করতে হয় না।
৮. সংজ্ঞায় নিয়ম অনুসরণ না করলে অনুপপত্তি ঘটে। কিন্তু বর্ণনার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করতে হয় না বলে এখানে অনুপপত্তির প্রসঙ্গ অবান্তর।
৯. সংজ্ঞা সব সময় সদর্থক হবে। কিন্তু বর্ণনা যেমন সদর্থক হতে পারে, তেমনি নঞর্থক হতে পারে।
১০. সংজ্ঞেয় পদ ও সংজ্ঞার্থ পদের ব্যক্তর্থ সমান হতে হয়। কিন্তু বর্ণিত বিষয় ও বর্ণনার মধ্যে এরূপ কোন সম্বন্ধ থাকা অনিবার্য নয়।
উপসংহারঃ সংজ্ঞা ও বর্ণনার মাঝে উল্লেখিত পার্থক্যসমূহ থাকলেও যেসব পদের সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়, সেসব পদের বর্ণনার সাহায্য গ্রহণ করতে হয়।
  
সহায়ক গ্রন্হাবলীঃ
১. উচ্চ মাধ্যমিক যুক্তিবিদ্য- ১ম পত্র (অবরোহ)
শরীফ হারুন
২. উচ্চ মাধ্যমিক যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র (অবরোহ)
প্রফেসর মোঃ গোলাম মোস্তফা
৩. উচ্চ মাধ্যমিক যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র (অবরোহ)
প্রফেসর মোহাম্মদ নূরনবী।

বিঃ দ্রঃ- উক্ত পাঠে কোন রকম ভূল-ভ্রান্তি এবং অসঙ্গতি দেখলে অবশ্যই তা মন্ন্তব্যের ঘরে মন্তব্য করে জানাবেন।

 বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার : http://www.kamdc.com

No comments: