পাঠের শিরোনামঃ অবৈজ্ঞানিক আরেহের সংজ্ঞা ও উদাহরণ দাও। বৈজ্ঞানিক আরোহের সাথে অবৈজ্ঞানিক আরোহের পার্থক্য আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ
কয়েকটি বিশেষ বস্তু বা ঘটনার অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে কোন সার্বিক
সিদ্ধান্ত অনুমান করার প্রক্রিয়াকে আরোহ বলে। যুক্তিবিদ মিল আরোহকে প্রথমত
দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন, যথা- প্রকৃত আরোহ ও অপ্রকৃত আরোহ। প্রকৃত আরোহ আবার
তিন প্রকার, যথা- বৈজ্ঞানিক আরোহ, অবৈজ্ঞানিক আরোহ ও সাদৃশ্যানুমান। আরোহ
যুক্তিবিদ্যায় বৈজ্ঞানিক ও অবৈজ্ঞানিক আরোহ অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং
তাদের মধ্যে কিছু বিষয়ে সাদৃশ্য থাকলেও অনেক বিষয়ে পার্থক্য বিদ্যমান।
অবৈজ্ঞানিক আরোহঃ
যে আরোহ অনুমানে কোন কার্য-কারণ সম্পর্ক নির্ণয় না করে শুধুমাত্র প্রকৃতির
নিয়মানুবর্তিতা নীতি ও ব্যতিক্রমহীন অবাধ অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে একটি
সার্বিক সংশ্লেষক যুক্তিবাক্য স্থাপন করা হয় তাকে অবৈজ্ঞানিক আরোহ অনুমান
বলে। অবৈজ্ঞানিক আরোহে আমরা আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের উপর
ভিত্তি করে একটি সার্বিক সিদ্ধান্ত অনুমান করি।
এ প্রসঙ্গে যুক্তিবিদ মিল
বলেন, “যে সব বাক্য আমাদের অভিজ্ঞতার অন্তরগত প্রত্যেক ঘটনার ক্ষেত্রে
সত্য সেই সব বাক্য সাধারণ সত্যে অভিষিক্ত করাই হলো অবৈজ্ঞানিক আরোহ।”
অবৈজ্ঞানিক আরোহের মূল কথা হলো- ‘এ ধরনের ঘটনা সর্বদায় ঘটতে দেখেছি, এর
বিপরীত কোন দৃষ্টান্ত কখনও চোখে পড়েনি; সুতরাং এ ধরনের ঘটনা সব ক্ষেত্রেই
সত্য।’
উদাহরণস্বরূপঃ সকল কাক হয় কালো।
আমরা আমাদের
অভিজ্ঞতায় শুধুমাত্র কালো রঙের কাক দেখেছি, ভিন্ন কোন রঙের কাক কখনও চোখে
পড়েনি। সুতরাং কাকের কালো রঙ সম্বন্ধে আমাদের এ অবাধ ও ব্যতিক্রমহীন
অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে আমরা অনুমান করি যে, সকল কাক হয় কালো।
বৈজ্ঞানিক আরোহঃ
যে আরোহ অনুমানে প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতা নীতি ও কার্য-কারণ নিয়মের উপর
নির্ভর করে কয়েকটি বিশিষ্ট দৃষ্টান্তের অভিজ্ঞতার সাহায্যে একটি সার্বিক
সংশ্লেষক যুক্তিবাক্য স্থাপন করা হয় তাকে বৈজ্ঞানিক আরোহ অনুমান বলে।
উদাহরণস্বরূপঃ
রহিম হয় মরণশীল
করিম হয় মরণশীল
শারমিন হয় মরণশীল
সকল মানুষ হয় মরণশীল।
এখানে আমরা কয়েকটি
ব্যক্তি মানুষের মৃত্যুর বাস্তব দৃষ্টান্ত পর্যবেক্ষণ করে ‘মানুষ’ ও
‘মরণশীলতার’ মধ্যে একটি কার্য-কারণ সম্পর্ক আবিস্কার করি এবং প্রকৃতির
নিয়মানুবর্তিতা নীতিতে বিশ্বাস স্থাপন করে সকল মানুষের মরণশীলতা সম্পর্কে
সিদ্ধান্ত অনুমান করি।বৈজ্ঞানিক ও অবৈজ্ঞানিক আরোহের মধ্যে পার্থক্যঃ বৈজ্ঞানিক ও অবৈজ্ঞানিক আরোহ -উভয়ই প্রকৃত আরোহের অন্তরভূক্ত হলেও তাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। নিম্নে তা আলোচিত হলো-
১. বৈজ্ঞনিক
আরাহ অনুমান প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতা নীতি ও কার্য-কারণ নিয়মের ভিত্তিতে
সার্বিক সংশ্লেষক যুক্তিবাক্য স্থাপন করে। অপরপক্ষে, অবৈজ্ঞানিক আরোহ
কেবলমাত্র প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতা নীতির শিথিল প্রয়োগের ভিত্তিতে সার্বিক
সংশ্লেষক যুক্তিবাক্য স্থাপন করে। কার্য-কারণ নিয়মের উপর অবৈজ্ঞানিক আরোহ
অনুমান প্রতিষ্ঠিত নয়।
২. বৈজ্ঞানিক
আরোহ অনুমান সদর্থক ও নঞর্থক উভয় প্রকার দৃষ্ঠান্ত পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ
করে সিদ্ধান্ত স্থাপন করা হয়। এখানে যেমন সদর্থক বা অনুক’ল দৃষ্ঠান্ত
পরীক্ষা- নিরীক্ষা করা হয় তেমনি নঞর্থক বা প্রতিকূল কোন দৃষ্ঠান্ত আছে কিনা
তাও অনুসন্ধান করা হয়। কিন্তু অবৈজ্ঞানিক আরোহ অনুমানে কেবলমাত্র কয়েকটি
সদর্থক দৃষ্ঠান্ত দেখে সিদ্ধান্ত স্থাপন করা হয়। কোন নঞর্থক বা প্রতিকূল
দৃষ্ঠান্ত আছে কিনা তা দেখা হয় না।
৩. বৈজ্ঞানিক
আরোহ অনুমান একটি জটিল প্রক্রিয়া। কারণ, এ অনুমানে কার্ষ-কারণ সম্পর্ক
নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষণাত্মক পদ্ধতির বিভিন্ন ধাপ যথা- সংজ্ঞা, পর্যবেক্ষণ,
বিশ্লেষণ, অপনয়ন, প্রকল্প প্রনয়ন প্রভৃতি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। অন্যপক্ষে,
অবৈজ্ঞানিক আরোহ অনুমান একটি সহজ-সরল প্রক্রিয়া। কারণ, এ অনুমানে ঐ সমস্ত
ধাপগুলো অতিক্রম করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় না। এখানে কেবলমাত্র কয়েকটি
সদর্থক দৃষ্ঠান্ত পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
৪. বৈজ্ঞানিক
আরোহ অনুমানের সিদ্ধান্ত বিজ্ঞানসম্মত ও সুনিশ্চিত। কেননা, এখানে ব্যাপক
অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং তা কার্য-কারণ নিয়মের উপর
প্রতিষ্ঠিত। অপরদিকে, অবৈজ্ঞানিক আরোহ অনুমানের সিদ্ধান্ত
অনিশ্চিত বা সম্ভাব্য। কারণ, এখানে অনেক সময় সীমিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কার্য-কারণ সম্পর্ক নির্ণয় না করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
৫. বৈজ্ঞানিক
আরোহ অনুমান বস্তুগতভাবে সত্য আশ্রয়বাক্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে দৃষ্ঠান্তের
সংখ্যার বদলে দৃষ্ঠান্তের পর্যবেক্ষণ মানের উপর গুরুত্ব আরোপ করে।
পক্ষান্তরে, অবৈজ্ঞানিক আরোহ অনুমান দৃষ্ঠান্ত পর্যবেক্ষণের মানের পরিবর্তে
দৃষ্ঠান্তের সংখ্যার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে।
৬. বৈজ্ঞানিক
আরোহ অনুমান সার্বিক সত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আরোহের পদ্ধতি যথাযথভাবে
প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু, অবৈজ্ঞানিক আরাহ অনুমানে এই
পদ্ধতি যথাযথভাবে প্রয়োগের কোন চেষ্টা করে না।
৭. বৈজ্ঞানিক
আরোহ অনুমান বিজ্ঞানীদের ব্যবহারযোগ্য আরোহ প্রক্রিয়া। এতে যে সিদ্ধান্ত
স্থাপন করা হয় তাকে আবার প্রমাণও করা হয়। কিন্তু অবৈজ্ঞানিক আরোহ অনুমান
সাধারণ লোকের গঠিত আরোহ । এতে কোন সিদ্ধান্ত প্রমাণের কোন চেষ্টা করা হয়
না। তাই এটি সাধারণ লোকের আরোহ বা লৌকিক আরোহ নামে পরিচিত।
৮. বৈজ্ঞানিক আরোহ অনুমানে কোন সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করার সময় সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য ও
বিধেয়ের মধ্যে কিরূপ সম্বন্ধ আছে তা বিশ্লেষণ করা হয়। কিন্তু অবৈজ্ঞানিক
আরোহ অনুমানে এরূপ বিশ্লেষণের সাহায্য গ্রহণ করা হয় না।
৯. বৈজ্ঞানিক
আরোহ অনুমান বিশ্লেষণের সাহায্য গ্রহণ করে বলে অপ্রয়োজনীয় বিষয় অপসারণ বা
অপনয়ন করতে পারে। কিন্তু অবৈজ্ঞানিক আরোহ বিশ্লেষণহীন নিরীক্ষণের উপর
নির্ভর করে বলে অপনয়ন করতে পারে না।
উপসংহারঃ
উপরোক্ত আলোচনায় দেখা যায় যে, বৈজ্ঞানিক আরোহ অনুমানের তুলনায় অবৈজ্ঞানিক
আরোহ অনুমান অনেক কম নির্ভরযোগ্য। তবে যুক্তিবিদ বেকনের মত অবৈজ্ঞানিক
আরোহকে বালকসুলভ আচরণ তথা মূল্যহীন বলা ঠিক হবে না। বৈজ্ঞানিক আরোহের
অনুপস্থিতিতে অবৈজ্ঞানিক আরোহ অনুমান আমাদের কিছুটা সাহায্য করে। তাই আরোহ
যুক্তিবিদ্যায় অবৈজ্ঞানিক আরোহ অনুমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সহায়ক গ্রন্হাবলীঃ
১. উচ্চ মাধ্যমিক যুক্তিবিদ্য- ২য় পত্র (আরোহ)
শরীফ হারুন
২. উচ্চ মাধ্যমিক যুক্তিবিদ্যা ২য় পত্র (আরোহ)
প্রফেসর মোঃ গোলাম মোস্তফা
৩. উচ্চ মাধ্যমিক যুক্তিবিদ্যা ২য়পত্র (আরোহ)
প্রফেসর মোহাম্মদ নূরনবী।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার : http://www.kamdc.com